শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৩:১০ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
আল্লাহর সৃষ্টির সবকিছু সুন্দর…..!

আল্লাহর সৃষ্টির সবকিছু সুন্দর…..!

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী: বিচলিত এক লোক হঠাৎ ঢুকে পড়ল পথের ধারে এক বাড়িতে। তার চোখে-মুখে আতঙ্ক। কাঁপছে, মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। বাড়িওয়ালা দেখে ভড়কে গেল। কী হলো, কোত্থেকে এলো, মর্জি কী? বাড়িতে হানা দেওয়ার কোনো কৌশল নাকি? কিন্তু এমন ভদ্র বুড়ো লোক সম্পর্কে এরূপ ধারণা অমূলক। লোকটিকে সান্ত¡না দেওয়ার সুরে তিনি বললেন, কী হয়েছে, কাঁপছেন কেন? এমন দিশাহারা পেরেশান কেন? বসেন, কথা বলেন, কী দেখেছেন,
ওয়াকেআ চোন আস্ত চোন বগুরীখতি
রঙ্গে রোখসারে চুনীন চোন রীখতি
কী হয়েছে বলেন, কেন এভাবে পালাচ্ছেন?
চেহারার রং এভাবে হলুদাভ কেন করলেন?
লোকটি বলল, জানেন কী? দেশে যে স্বৈরশাসক সবকিছুর দ-মু-ের মালিক হয়ে বসে আছে, জনগণের ওপর জুলুম নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাচ্ছে, আজ তার লোকরা যানবাহন আটক করছে। এ রিকুইজেশন থেকে রেহাই পাচ্ছে না গণপরিবহন গাধা। বাড়িওয়ালা এতক্ষণে বুঝতে পারল। বলল, মামা! কই গাধা? আপনি তো গাধা নন। আপনাকে তো ওরা ধরবে না। আপনি কেন এত বিচলিত? গাধা ধরা হচ্ছে তাতে আপনি কেন ভীত?
পলাতক লোকটি বলল, আপনার কথা ঠিক আছে। তবে সরকারের বিশেষ বাহিনীর তো কোনো বাছবিচার নেই। ওরা যদি গাধার পরিবর্তে আমাকেই ধরে ফেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দেশটা তো এভাবেই চলছে। সরকারের লোকরা এমন বেপরোয়া, জনগণের ভাগ্য নিয়ে এমনভাবে ছিনিমিনি খেলছে তাতে কোনটা গাধা কোনটা মানুষ, সেই বোধটুকু তাদের নেই।
চোনকে বী তাময়ীযিয়ান মান সারওরান্দ
সাহেবে খর রা বে জা’য়ে খর বারান্দ
বেয়াদবরা যেহেতু আমাদের শাসক হয়ে বসেছে
গাধার পরিবর্তে গাধার মালিক ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
দেশটা মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতা দখল করেছে কতক বেতমীয বেয়াদব। এরা মূর্খ। মূর্খতার কারণে কোনটা গাধা কোনটা মানুষ ফারাক করার বোধটুকু নেই। এরা অহংকারী, দাম্ভিক, মানুষকে মানুষ মনে করে না। তাদের কাছে মূর্খ দুর্নীতিবাজরা সম্মানিত। জ্ঞানীমহল আলেমদের মুখে লাগাম দিয়েছে। সত্য কথাটি বলার সাহস পরিবেশ দেশে নেই।
জনগণের ভাগ্যের ওপর চাপিয়ে বসা জালেম বাদশাহর স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে মওলানার মনে পড়ে গেল আরেকজন বাদশাহর কথা। অমনি তিনি উড়াল দিলেন আকাশে। একেবারে ঊর্ধ্বলোকে, যেখানে আছেন মহামহিম শাহানশাহ।
নীস্ত শাহে শহরে মা বীহুদা গীর
হাস্ত তাময়ীযাশ সমী আস্তো বসীর
অনর্থক ধরেন না আমাদের শহরের বাদশাহ
বাছবিচার আছে তার সর্বদর্শী ও সর্বশ্রোতা।
আমাদের শহরে যিনি রাজত্ব করেন, এ জগতের প্রকৃত রাজত্ব যার হাতে তার পরিচয় নাও। তিনি অনর্থক কারও হয়রানি করেন না। নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দেন না। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করেন না। সবার সবকিছুর চূড়ান্ত ক্ষমতা তার হাতে। তার কাছে ন্যায়-অন্যায়ের বাছবিচার আছে। তিনি সর্বশ্রোতা। সবার সবকিছু দেখছেন। জগৎসংসারকে তিনি বৈচিত্র্যে সাজিয়েছেন। উদ্দেশ্য হলো, ভালো থেকে মন্দকে পৃথক করা। তারপর শেষ পরিণাম হবে, ‘তা এজন্য যে, আল্লাহ অসৎলোককে সৎলোক থেকে পৃথক করবেন এবং অসৎলোকদের এককে অপরের ওপর রাখবেন, অতঃপর সবাইকে স্তূপীকৃত করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। এরাই হলো ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সূরা আনফাল : ৩৭)।
আদমী বা’শ ও যে খরগীরা’ন মাতার্স
খ’র নয়ী আই ঈসায়ে দাওরান মাতার্স
মানুষ হও গাধা ধরাদের ভয় পেয়ো না
তুমি গাধা নও, হে যুগের ঈসা! ভয় পেয়ো না।
তুমি মানুষ হওয়ার চেষ্টা কর। যদি প্রকৃত মানুষ হতে পার, নফসকে যদি রুহের অনুগত করতে পার, তাহলে তুমি এ যুগের ঈসা। অর্থাৎ দুনিয়াবি আকর্ষণ ও লোভ-লালসার বন্ধন থেকে মুক্ত। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। গাধার স্বভাব তোমার মাঝে নেই; তাই পরিস্থিতির সব প্রতিকূলতা ডিঙে তুমি সত্যের ওপর অবিচল থাকতে পারবে। যদি নিজেকে সেই স্তরে উন্নীত করতে চাও, তাহলে জেনে রাখ যে,
এই দুনিয়ায় সিঁড়ির বহু ধাপ আছে সংগোপনে
পায়ে পায়ে এই সিঁড়ি চলে গেছে ঊর্ধ্বে আসমানে।
এই বয়েতের ব্যাখ্যা আছে মওলানার আরেকটি গদ্য কিতাবে। ‘(তাকে পাওয়ার পথ) যদিও ভিন্ন ভিন্ন হয়; কিন্তু মকসুদ (লক্ষ্যস্থল) এক। তুমি কি দেখ না যে, কাবাঘরে যাওয়ার পথ ভিন্ন ভিন্ন আছে। কারও জন্য রোম থেকে যাওয়ার পথ আছে। কারও পথ সিরিয়ার দিক থেকে। কেউ যায় আজম (ইরান) থেকে। কেউ চীন দেশ থেকে। কারও পথ সাগরপথে। কারও পথ হিন্দুস্তান ও ইয়েমেন থেকে। কাজেই যদি পথগুলোকে বিবেচনায় নাও বিশাল তফাৎ ও দূরত্ব তোমার নজরে আসবে। কিন্তু যদি মকসুদকে বিবেচনায় নাও দেখবে সবাই এক, একই লক্ষ্যমুখী। (ফীহে মা ফীহে, পৃ.৯৭)।
হার গুরুহ রা নর্দবা’নি দীগর আস্ত
হার রবিশ রা আ’সেমানী দীগর আস্ত
প্রত্যেক দলের জন্য আছে সিঁড়ি পৃথক পৃথক
যে কোনো তরিকার জন্য আছে আসমান পৃথক।
এই পথ সাধনার। আধ্যাত্মিক সাধনায় একেকজন একেক স্তরে থাকে। তবে আল্লাহর সান্নিধ্যের কাছে গেলে সব পথ এক জায়গায় মিলে গেছে। যাত্রাপথে একজনের খবর আরেকজনের থাকে না। কারণ আল্লাহর এই জগৎ বিশাল বিস্তৃত যেন অনন্ত শামিয়ানা। কোরআন মজিদে বলা হয়েছে, ‘যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম (সাধনা) করে তাদের অবশ্যই আমার পথসমূহে পরিচালিত করব। আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে থাকেন।’ (সূরা আনকাবুত : ৬৯)।
আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পথসমূহে’। মানে অনেক পথ আছে। বয়েতের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাকে জাগতিক ব্যাখ্যায় আমরা সম্প্রসাতি করতে পারি। পৃথিবীর বাস্তবতা হলো, আমরা বিভিন্ন দল, তরিকা, সম্প্রদায়ে বিভক্ত। অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন পথ ও পন্থায় আল্লাহর পথে সাধনা করছি। কিন্তু সবার পথ যে লক্ষ্যে গিয়ে শেষ হয়েছে, তাহলো আল্লাহ, আল্লাহর দ্বীন। আমরা বিভিন্ন মসজিদে নামাজ পড়ি। যেহেতু আল্লাহর ইবাদতই আসল লক্ষ্য; তাই মুসল্লিদের মাঝে কোনো বিরোধ, ভিন্নতা নেই। যেখানে স্বার্থচিন্তা প্রবল হয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্য থেকে দৃষ্টি বিচ্যুত হয়, সেখানেই বিরোধ দেখা দেয়। ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করে; তবে পরীক্ষা দেয় এক বোর্ডের অধীনে। কাজেই সবাই এক।
মওলানা রুমি (রহ.) এর এ দর্শনের মাঝে নিহিত আছে মুসলিম সমাজে সাম্য ও সম্প্রীতির বীজ। এমনকি গোটা মানব সভ্যতার জন্য আলোকবর্তিকা রয়েছে এ জীবন দর্শনে। তিনি আরও বলেন,
সাহনে আর্দুল্লাহে ওয়াসে’ আমাদে
হার দেরাখতী আয যমীনী সারযাদে
আল্লাহর জমিন প্রশস্তÑএই ঘোষণা এসেছে
প্রতিটি গাছ একেক জমি থেকে উৎপন্ন হয়েছে।
কোরআন মজিদের একাধিক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহর জমিন প্রশস্ত।’ (সূরা নিসা : ৯৭; সূরা আনকাবুত: ৫৬ ও সূরা জুমার: ১০)। মওলানা রুমি (রহ.) এর দৃষ্টিতে আল্লাহর জমি বলতে গোটা অস্তিত্ব জগৎ। এখানে বিভিন্ন সৃষ্টি ভিন্ন ভিন্ন গাছের মতো। একই গাছ ভিন্ন ভিন্ন জমিনে লাগালে স্বাদ হয় ভিন্ন ভিন্ন। মরহুম অধ্যক্ষ এ এ রেজাউল করিম চৌধুরীর কথা মনে পড়ে। চট্টগ্রামের একজন প্রথিতযশা প-িত ছিলেন তিনি। এক মজলিসে উদ্ভূত এক বিতর্কের সমাধানে মাইক্রোফোনের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে তিনি বলেছিলেন, মদিনা শরিফে খেজুর গাছ আছে, সেই গাছে ফল ধরে, দামি খেজুর। আমাদের দেশেও খেজুর গাছ আছে, এখানকার খেজুর গাছ মদিনার মতো নয়। এখানে ফল ধরে না, রস পাওয়া যায়। কাজেই মদিনার ইসলাম এখানে আসার পর একটু ব্যতিক্রম মনে হবেই। মেনে নিতে পারলেই শান্তি আসবে।
সৃষ্টিলোকের বৈচিত্র্যের মাঝেই আমাদের সন্ধান করতে হবে মহাবিশ্বের ঐক্যতান। বাগানে হরেক রকম ফুল থাকে। যদি সব ফুল গোলাপ হতো, গোলাপের মর্যাদা নির্ণয় করা কঠিন হতো। বাগানে সৌন্দর্যের বাহার আসত না। কাজেই ভালো-মন্দ মিলিয়ে এ জগৎসংসারের সবকিছুই সুন্দর। এখানে ভালো ও মন্দ, সৎ ও অসৎদের পরস্পর থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করাই আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায়। সৃষ্টিরহস্যের এ তত্ত্ব যারা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে, তারা বলে, ‘হে আমাদের প্রভু! তুমি কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করোনি।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৯১)। আল্লাহর এ গুণগান শুধু মানুষ জিনপরি প্রাণীরা করে না; বরং গাছের পাতাপত্রও অবিরত তসবিহ পাঠ করে।
বর দেরাখতান শোকর গূয়ান বর্গো শা’খ
কে যেহী মুলক ও যেহী আরচেয়ে ফরা’খ
পাতাপত্তর শাখারা শোকর গায় গাছের ডালে
কী সুন্দর এই দেশ কত প্রসারিত জগৎ বলে।
বুলবুলান গের্দে শেকূফে পুর গেরেহ
কে আয অ’ঞ্চে মী খুরি মা’ রা’ বেদেহ
ফুলের শাখে দোলে বুলবুল পাপড়ির বুকে ঠোঁটে চেপে
কী সুধা, কত মজা একা খেয়ো না, দাও আমায় বলে।
জগৎ ও জীবনের প্রতি এ দৃষ্টিভঙ্গি মানবজাতির জন্য আলোকবর্তিকা। বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের সন্ধান করতে পারলেই জীবন সুখী হবে। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোথাও কোনো খুঁত নেই। কাজেই আমি যেসব অসংগতি দেখি, তা আমার দৃষ্টিভঙ্গির গলতি। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারলেই জীবন বদলে যাবে। অনেক কিছুর রহস্য বোধগম্য হবে। তখন আল্লাহর অগণিত সৃষ্টির বৈচিত্র্যের পরতে সাজানো সৌন্দর্য আমরা উপভোগ করতে সক্ষম হব।
(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-২৫৩৮-২৫৬৩)

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877